ম্যাডিসন স্কয়ারে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন

প্রকল্পের টাকায় হয় কনসার্ট, মহোৎসবে মাতেন মন্ত্রী থেকে আমলারা

আরফিন শরিয়ত

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে নিউইয়র্কে ২০২২ সালে কনসার্ট আয়োজন করে আইসিটি বিভাগ ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজন করা হয়েছিল ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’। ২০২২ সালের ৬ মে ওই কনসার্টের আয়োজক ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। দেশ থেকে উড়িয়ে নেয়া হয় জনপ্রিয় ব্যান্ড চিরকুটকে। এ আয়োজনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে অন্তত শতাধিক আমলা। বাদ যাননি সংশ্লিষ্টদের পরিবার থেকে শুরু করে আইসিটি বিভাগের পিয়ন-কর্মচারীরাও। জাঁকজমকপূর্ণ এ আয়োজনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার সিংহভাগই মেটানো হয় আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে। 

আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই আয়োজন ছিল সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার অন্যতম টুল। এর মাধ্যমে পূরণ হয় মন্ত্রী থেকে আমলা–সবার ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষা। শুধু একটি থেকেই নয়, এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রকল্পের বরাদ্দের অর্থ সরিয়ে চলে তাদের এ মহোৎসব। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে সে বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়। সেখানে অর্থেরও প্রাক্কলন করা হয়। পরবর্তী সময়ে সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কনসার্ট আয়োজনের জন্য কোনো প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে যদি অর্থ নেয়া হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে ওই প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ দেয়া হয়েছে কিংবা সে কাজটিই সঠিকভাবে হচ্ছে না।  

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিদেশ ভ্রমণের জিও থেকে দেখা যায়, গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট উপলক্ষে নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন আইসিটি বিভাগের ৭২ কর্মকর্তা। আর সেই আয়োজনটি করতে গিয়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয় আইসিটি বিভাগের। এছাড়া অর্থ বিভাগ থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল আরো ৫ কোটি টাকা। 

কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী একেএম মোজাম্মেল হক ও তার ব্যক্তিগত সচিব মোহাম্মদ সানাউর হোসেইন; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম, সাদ্দাম হোসেন, একরামুল হক, ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলাম; সংসদ সদস্য নাহিদ এজহার খান, মো. নুরুল আমিন, অপরাজিতা হক; পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী; প্রধানমন্ত্রী অফিসের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য কর্মকর্তা জুয়েনা আজিজ; হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. বিকর্ণ কুমার ঘোষ; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের মহাপরিচালক মো. রেজাউল মাকসুদ জাহেদী; এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ মেহেদি হাসান; আইসিটি বিভাগের উপসচিব ইসরাত জাহান; প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ। এছাড়া আইসিটি বিভাগ ও অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব, প্রকল্প পরিচালক, উপপরিচালক, প্রোগ্রামার, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার, কনসালট্যান্ট সেই কনসার্টে অংশ নিতে নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। প্রত্যেকের ব্যয়ই বহন করেছিল আইসিটি বিভাগ। 

জানা গেছে, অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন ছয় থেকে সর্বোচ্চ ১৪ দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন। তাদের সব ব্যয় বহন করা হয় আইসিটি বিভাগ, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর এবং সংস্থাগুলোর অধীন সাত প্রকল্প থেকে। এর মধ্যে রয়েছে এস্টাবলিশমেন্ট অব শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবিশন সেন্টার (১১ জেলা), ইনফো সরকার-৩, ডিজিটাল অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড ইনোভেশন ইকোসিস্টেম ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট, ১২ জেলা আইটি/হাই-টেক পার্ক প্রকল্প, এস্টাবলিশমেন্ট অব সিএ মনিটরিং সিস্টেম অ্যান্ড সিকিউরিটি, এস্টাবলিশমেন্ট অব আইটি বিজনেস অ্যাট চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, এস্টাবলিশমেন্ট অব শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবিশন সেন্টার প্রকল্প। 

জানতে চাইলে আইসিটি বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আ ন ম জিয়াউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ কনসার্ট অনেক আগেই আয়োজন করা হয়েছে। তখন আমি সিনিয়র সচিব ছিলাম। আয়োজনটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষকে। তিনিই সব দেখভাল করেছেন। ওই সময়ের ঘটনার তেমন কিছু এখন আর মনে নেই।’ 

ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’ আয়োজনের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল, তারাই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. বীকর্ণ কুমার ঘোষ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিনিধি এ কমিটিতে ছিলেন। আমাকে শুধু কনসার্ট বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। পুরো কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না।’

যুক্তরাষ্ট্রে নানাভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ কনসার্টের মাধ্যমে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছিল। নিউইয়র্কের রাস্তার পাশে মাসব্যাপী সেসব উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রচারণা দৃশ্যমান ছিল। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বাংলাদেশকে নতুন করে চেনে। বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিংও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ভাবমূর্তিও ফোকাস হয়ে গিয়েছিল তখন। ওই সময় ইউএনডিপির সাইবার বুলিং অ্যাওয়ার্ড প্রদানেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।’ 

বাংলাদেশ থেকে কিছু কোম্পানি আয়োজনে স্পন্সর করেছিল বলে দাবি করে হাই-টেক পার্কের সাবেক এমডি বলেন, ‘তারা সেখানে (নিউইয়র্ক) আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তবে কীভাবে সব নির্ধারিত হয়েছিল তা নীতিনির্ধারকরাই বলতে পারবেন।’ 

রাজধানীর নাখালপাড়ার মেইনস্প্রিং লিমিটেড নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের সঙ্গে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য চুক্তি হয়েছিল। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ৩৪ কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার টাকায় চুক্তিটি করেছিল তাদের সঙ্গে। তবে নিজেরা দায়িত্ব না নিয়ে মেইনস্প্রিং লিমিটেড কাজটি পারাস এন্টারটেইনমেন্ট নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে। 

হাই-টেক পার্কের সাবেক এমডি বীকর্ণ কুমার ঘোষ এ বিষয়ে বলেন, ‘ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন ভাড়া করা এবং স্করপিয়নের মতো একটি জনপ্রিয় বৈশ্বিক ব্যান্ডকে নিয়ে আসার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তাই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারাই সবকিছুর আয়োজন করে। তারা যদি সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে থাকে তবে সেটাও বৈধ।’ 

জানা যায়, আয়োজনের সময় ট্রাম্প টাওয়ারে হলরুম ভাড়া নিয়ে রোড শো আয়োজনের ব্যবস্থা করে আইটি হাব নামে দেশীয় একটি কোম্পানি। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নেয়া হয়েছিল এ উদ্যোগ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওই উদ্যোগ থেকে কী উপকার হয়েছে আমি জানি না। শুধু এতটুকু দেখেছি, একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে প্রতিমন্ত্রীসহ কিছু বক্তা এসেছিলেন, তারা নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।’ 

নতুন বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বীকর্ণ কুমার বলেন, ‘ওই অনুষ্ঠানের পর আমাদের এখানে একটি আমেরিকান কোম্পানি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তারা আমাদের এখানে বিনিয়োগও করেছে।’ তবে ওই কোম্পানি সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি। 

এ সম্পর্কে জানতে আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মেহেদি হাসানকে মুঠোফোন কল ও খুদে বার্তা দেয়া হয়। কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি। পরে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। 

এ আয়োজনে অংশ নেন দেশীয় ব্যান্ড চিরকুট। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর গ্লোবাল বাংলাদেশী ব্যান্ড নাম ধরে জনপ্রিয় ব্যান্ড দলটি। অনুষ্ঠানের সঙ্গে চিরকুটের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানতে চাইলে চিরকুটের ভোকাল শারমিন সুলতানা সুমি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনুষ্ঠানের এক মাস আগে আমরা আয়োজক প্রতিষ্ঠান মেইনস্প্রিং থেকে কল পাই। তারা আমাদের সেই শোতে অংশগ্রহণ করতে বলেছিলেন। সে হিসেবে আমরা অংশগ্রহণ করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ২০১২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শো করে আসছি। সেই থেকে আমাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা আছে। হয়তো এর জন্যই আমাদের ডাকা হয়।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন